রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২৪ ভাদ্র, ১৪৩১
Live TV
সর্বশেষ

লেখনীতে সাখাওয়াত হোসেন

আফরিন

দৈনিক দ্বীনের আলোঃ সাখাওয়াত হোসেন
১৬ মে, ২০২৪, ১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ | 122
আফরিন
১৬ মে, ২০২৪, ১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ | 122

পাঁচ বৎসর আগে এক বইমেলায় আফরিন আমায় একটা কলম উপহার দিয়েছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কলমটির নাম মন্তেগ্রাপ্পা তিবালদি ফুলগর নকটারনাস। ইতালির কলম। দাম, পঞ্চান্ন কোটি টাকা। ওই কলমে সেঁটে আছে নয়শো কালো হীরা ও একশো চুনি। ওটির নিব কেনার সাধ্যও আফরিনের নেই। আমায় উপহার দেওয়া কলমটির গায়ে হীরা চুনি বসানো ছিল না কোনো। বরং একটা নাম ছিল খচিত, ইকোনো। দাম ছিল, আট টাকা। আমি কলম হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা দিয়ে কী করবো?
‘লিখবে।’
‘লেখার জন্য কী-বোর্ড আছে। আজকাল কলম দিয়ে কেউ লেখে নাকি?’
‘তুমি লিখবে। কী-বোর্ডের গল্পের চেয়ে কলমের গল্প ভালো হয় তোমার।’
আমার মন খারাপ হয়ে গেল। অথচ অমন মারদাঙ্গা অসহিষ্ণু আমি নই। অনলাইনে টুকটাক গল্প লিখি। অন্দ-মন্দ সবরকম সমালোচনা খুব ভালো করে নিই। মন থেকে বিশ্বাস করি, অনর্গল প্রশংসার চেয়ে খানিকটা নিন্দে ভালো। প্রশংসা নষ্ট করে শিল্পীকে, নিন্দে করে ঝালাই। অথচ বইমেলায় অমন হট্টগোলের ভীড়ে সম্মুখে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা আফরিনের দিকে তাকিয়ে আমার মুখ অন্ধকার হয়ে এলো। আমি কলমটা পকেটে ঢুকিয়ে বললাম, ও।
‘ও কী?’
‘কিছু না।’
‘মন খারাপ করেছো?’
‘মন খারাপ করবো কেন? আশ্চর্য!’
আফরিন হেসে ফেলল তখন। আর আমার হাত ধরে হাঁটলো সারা মেলা। হাঁটতে হাঁটতে বুঝালো, কী-বোর্ড তোমায় গতি দিয়েছে, অনুভূতি কমিয়েছে দ্বিগুণ হারে। তুমি শুধু একটানা ছুটছো, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকছো না একদম। আমি হাত ছুটিয়ে বললাম, বাসায় যাবো।
‘আরেকটু থাকি? সন্ধ্যে হোক।’
‘না।’
‘আচ্ছা, তুমি সবার সমালোচনা নিতে পারো। আমি কিছু বললেই মন খারাপ করো কেন?’
‘জানি না।’
আমি আফরিনকে রেখে ওই দিন চলে আসলাম বাসায়। সন্ধ্যে পর্যন্ত বইমেলায় একা একা ঘুরে বেড়ালো সে। সন্ধ্যের পর আমায় ফোন দিলো। আমি ফোন উঠালাম না। তক্কে তক্কে রইলাম, দ্বিতীয়বার ফোন দিলে আছাড় দেবো ওটা। আফরিন আমার নাড়িনক্ষত্র জানে। দ্বিতীয়বার ফোন দিলো না আর। আমি বারান্দায় জবুথবু হয়ে বসে রইলাম। মন প্রচণ্ড খারাপ। অমন না যে আফরিন রোজ আমায় বলে, তোমার গল্প ভালো হচ্ছে না। আমার গল্প নিয়ে খুব একটা মতামত সে জানায় না। হয়তোবা এক দুই মাসে একবার। জানিয়েই তার আক্কেল হয়। কারণ, পরবর্তী তিন-চার দিন আমি ভুগি প্রচণ্ড হতাশায়। আমার মাথায় চেপে বসে, আমি আর লিখতে পারবো না কোনোদিন। আমি আফরিনকে মুগ্ধ করতে পারবো না একদম।
আফরিন আমায় ভালোবেসেছে। আমি জানি, আমায় অর্থাৎ আমার আমূল সত্ত্বা তার পছন্দ। আমি মানুষটা যেমন, আমার স্বভাব যেমন, আমার অন্দর যেমন অথবা আমার মানসিকতা। আবার আমার মধ্যকার লেখালিখিটাও তার ভালোবাসার অংশ। আমি যদি লিখতে না পারি, তবে তার ভালোবাসার একটা অংশ হবে উধাও। ফলাফল, আফরিন মন খুলে কোনোদিনও বলতে পারতো না, আমার ওই গল্পটা কেন ভালো হয়নি। ওটা আমি সহজভাবে নিইনি কোনোদিন। দুনিয়ার সবার নিকট থেকে প্রাপ্য সমালোচনা আমি স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করতে পারি, আফরিন থেকে নয়। আফরিন আলাদা। অথচ আফরিন চাইলো, আমি যাতে আরও ঢুকি গল্পের গভীরে। আমি যাতে প্রতিটা চরিত্রের হৃদয়ের ভেতর ঢুকে খামচে ধরতে পারি অনুভূতি সব। কী-বোর্ডে আমার অন্দর ঢুকা হয় না কারোর। কলমে ঢোকা হয় ঠিক।
বইমেলার তৃতীয় দিনের মাথায় আমি অন্ধকার মুখ করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমার কী-বোর্ড আর কলমের পার্থক্য কিভাবে বুঝতে পারলে? তোমায় আমি একটা চিঠিও লিখিনি কোনোদিন।
‘বাদ দাও। তোমার মন খারাপ করবে আবার। থাক।’
‘বলো।’
আফরিন একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, তোমার ডায়েরী। তোমার ডায়েরীতে লেখা প্রতিটি গল্প গভীর। ওখানে সর্বশেষ গল্প লিখেছো দুই বৎসর আগে। পড়ে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। তোমার ডায়েরীর গল্পের তুলনায় কী-বোর্ডের গল্প শিশু।
আমি হাহাকার করে উঠলাম, তুমি এমন কথা বলতে পারলে?
আফরিন বুঝতে পারলো, হড়বড় করে বলতে যেয়ে বেশী বলা হয়ে গেছে তার। সংশোধন করার উপায়ও নেই তখন। আফরিন আমার হাত ধরে হতাশ স্বরে বলল, এর মানে তুমি খারাপ লিখো তা না, তুমি চাইলে আরও ভালো লিখতে পারবে।
‘বাসায় যাবো।’
আমি তার হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে বাসায় চলে আসলাম। একলা রেখে। আফরিন একা একা বইমেলা ঘুরে বেড়ালো। সন্ধ্যের সময় আমায় ফোন দিলো। আমি ফোন হাতে নিয়ে দেয়ালে ছুঁড়ে মারলাম। স্ক্রিন ফেটে চৌচির। ব্যাটারি খুলে বিছানার তলায় গিয়ে পৌঁছুলো। বিচ্ছিরি বাসার বারান্দায় জবুথবু বসে ডায়েরীর পাতা উল্টালাম আমি। একটা সময় কলমে লিখতাম। লিখতে লিখতে মনে হতো, যা লিখছি, তা একান্তই আমার। ওখানে কারোর ভাগ নেই। কেমন একটা প্রবল স্বত্বাধিকার। আশ্চর্য মায়া। পকেট থেকে ওর দেওয়া ইকোনো কলম বের করে আমি ডায়েরীর শেষ দিককার পাতায় গুটি গুটি অক্ষরে লিখলাম, প্রিয় আফরিন, তুমি একটা ভীষন কঠিন খবিশ মানুষ।
লিখে নিচে নিজের নাম সই করলাম। কয়েকবার পড়লাম ওটা। বেশ ভালো লাগলো। আফরিন কোনো একদিন এসে ডায়েরীর পাতা উল্টাবে। উল্টে এই পৃষ্ঠায় এসে আক্কেল হবে তার। অমন আক্কেল হওয়া জরুরি। বাছ নাই, বিচার নাই, ফটাস করে যা-তা বলে ফেলা। খুব বাজে অভ্যাস।
.
আফরিন আমায় একটা কলম উপহার দিয়েছিল পাঁচ বৎসর আগে। বইমেলায়। আমি তাকে একটা বইও উপহার দিইনি। রাগের চোটে। দেওয়া উচিত ছিল। ক্যাম্পাসে ওর বান্ধবীরা যখন ভালোবাসার মানুষটির নিকট থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে বাচাল আলাপ দিচ্ছিলো, আমি দূর থেকে লক্ষ করেছি, আফরিন আড্ডার এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসে। তখনও আমার মাথায় রাগ ছিল। নয়তো ছুটে গিয়ে পাশে বসতাম তার। চুলে হাত বুলিয়ে বলতাম, তোমার কী চাই বলো। আফরিনই তো। সে চাইতো একটা বই। গাড়ি চাইতো না। প্রাসাদও না। যে বই চাইতো, ওই বইটাও খুব মোটাসোটা হতো না। চিকন স্বাস্থ্যের বই হতো তা। আর ওটা এনে দেওয়ার প্রক্রিয়াটাও তার জানা।
‘অমুক বুকশপ থেকে নেবে। ওরা ছাড় দিচ্ছে। অযথা পয়সা খরচ আমার পছন্দ না। সামনে সংসার-টংসার করবো দুইজন। অর্থের মূল্য দিতে শিখো। তাছাড়া আমি নিজেও তোমায় আহামরী দামী কিছু দিতে পারি না কখনও।’
তা সত্য। আফরিন আমায় কখনই একটা দামী শার্ট কিনে দেয়নি। যখন ক্যাম্পাসের আড্ডায় তার বান্ধবীরা ভালোবাসার মানুষটিকে দামী পারফিউম, শার্ট, টি-শার্ট আর জাঁকজমক উপহার প্রদান বিষয়ক আড্ডা নিয়ে ব্যস্ত, তখন আফরিন ওই আড্ডার এক কোণায় জবুথবু বসে থাকতো চুপচাপ। কারণ, অমন বিশেষ দিবসে আমাকে একটা ডায়েরী ছাড়া কিচ্ছু দেওয়া হয়নি তার। ওই ডায়েরীটাও কেনা ডায়েরী নয়। যে বাসায় টিউশনি করায় সে, ওই বাসার আংকেলের অফিস থেকে দেওয়া ডায়েরী। খুব সুন্দর। আমি হাতে নিয়ে চমকে গিয়েছিলাম। অমন দাম। কভার উল্টে দেখি একটা অফিসের নাম। আফরিন লাজুক মুখে বলল, কিনিনি, অত টাকা আমার আছে নাকি? আংকেল দিলো ওটা। আমি ডায়েরী নিয়ে কী করবো, ভাবলাম তোমায় দিই। তুমি তো লিখালিখি করো। এখানে লিখো।
আমি আফরিনকে হাড়ে হাড়ে জানি। আমি খুব ভালো করেই জানি, কোনোদিন প্রচুর অর্থ হলে সে আমায় পৃথিবীর সবচেয়ে দামী গাড়িটি কিনে উপহার দেবে। উপহার দেবে রাজপ্রাসাদ। নয়শো কালো হীরা আর একশোটা চুনি বসানো পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কলমটাও আমার পকেটে গুঁজে দেবে সে অনায়াসে। আমায় সে একটা ইকোনো কলম দেয়, একটা উপহার পাওয়া অন্য অফিসের ডায়েরী উপহার দেয়- কারণ তার প্রচুর টাকা নেই। একটা শহরে একলা তরুণীর যাপন করা জীবনের সঙ্গে তুলনা হয় না কিচ্ছুটির আর। আমি সব বুঝি। তাও ওর উপর রাগি হুটহাট। আমার রাগ শেষ হতে হতে বইমেলা শেষ হলো। মাস শেষ হওয়ার পর আমি আফরিনকে সুসংবাদ দিলাম।
‘উপন্যাস লিখতে শুরু করেছি আফরিন।’
‘বলো কী?’
‘সত্যি। মাথার মধ্যে সব ঘুরছে। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি মুহূর্ত।’
‘নিশ্চয় রোমান্টিক?’
‘অবশ্যই। তুমি আমার স্ট্রং জোন জানো।’
‘স্ট্রং জোনে সবাই ফাটায়। তুমি একটা এক্সপেরিমেন্ট করলে না কেন?’
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। আফরিন দ্রুত সংশোধন করে নিলো।
‘না মানে, তুমি তো রোমান্টিক ভালো লিখোই। একটু অন্যরকম লিখলে না কেন? ধরো, থ্রিলার, হরর, ফ্যান্টাসী।’
‘যেটা লিখছি, সেটা বন্ধ করে দেবো?’
‘এই না না। পাগল নাকি? দূর, আমার কথা মাথায় নিয়ো না তো। তুমি খুব ভালো লিখতে পারো। লিখো তুমি। যেমন ইচ্ছে লেখার তোমার কবিতার খাতা।’
আফরিন আমার দু’গাল টেনে দিলো আদর করে। আমার বুক থেকে একটা ভীষণ ভারী পাথর নেমে গেলো। যদিও আমি আফরিনের মতামত পাত্তা দিই না। কিন্তু সে যখন আমার গল্প মন্দ বলে, তখন আমার পুরো একমাস খারাপ যায়। সে যখন আমার প্রশংসা করে, তখন আমার পুরো এক বৎসর লম্ফঝম্পে কাটে। আমি তুমুল আগ্রহ নিয়ে শুরু করলাম আমার উপন্যাস। এবং সেটা অবশ্যই কী-বোর্ড ব্যবহার করে। কলমের অত গরজ নাই। প্রথম উপন্যাস। প্রথম সবকিছু কালজয়ী হয় না। কিন্তু আমায় প্রচণ্ড ভালো লিখতে হবে। সেটা শুধু নিজের স্বার্থে নয়। আমার উপর জমাট আফরিনের প্রচণ্ড বিশ্বাস। গত দু’টো বৎসর ধরে সে আমার কানে ফিসফিস করে গিয়েছে সর্বদা।
‘তোমার প্রথম উপন্যাস আমি দশ কপি কিনবো।’
‘ওমা! সে কি কথা?’
‘অবশ্যই কিনবো।’
‘লিখলে তো শুকনো বই হবে না, মোটাসোটাই হবে। দামও হবে ভারী। টাকা কই পাবে অত?’
‘আমি টিউশনির সব টাকা কি খেয়ে ফেলি? জমাই না?’
আফরিন টাকা জমায়। তা আমি জানি। সে কখনই রিকশায় চড়ে না। ক্যাম্পাস থেকে তার বাসার দূরত্ব রিকশা করে গেলে বিশ মিনিট। হেঁটে গেলে চল্লিশ। আমাদের দীর্ঘ সময়ের সম্পর্ক। ক্যাম্পাস গেইটে দাঁড়িয়ে আমি প্রতিদিনই দেখেছি ফুটপাত ধরে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে আসা এক তরুণী। লম্বা চুল তার। ওই চুল খোলা। দারুণ হাওয়ায় উড়ছে তা। কাঁধে ব্যাগ। কপালে ঘাম। গেইটে আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফিক করে ঠোঁটে ঝুলে যাওয়া একখানা হাসি। আমি ভুলতে পারি না একদম। আমার উপন্যাস নিয়ে তার আগ্রহ আমার চেয়েও বেশী। অমন কষ্ট করে হেঁটে এসে টাকা বাঁচানোর কারণ আছে বৈকি। সে শুনেছে নতুন লেখকদের বই বের হওয়া অত সহজ নয়। টাকা-পয়সা খরচ করতে হয় নিজ থেকে। আমি টাকা কই পাবো? আমার বাসা থেকে তো আমার লেখালিখিই সাপোর্ট করা হয় না। তার জন্য টাকা দেবে কেউ?
প্রথমদিন যখন আমি শুনলাম, ওই টাকা এই জন্য জমানো। হাসবো নাকি কাঁদবো ভেবে কূল পেলাম না। পরক্ষণে মাথায় চড়ল রাগ। অমন কাণ্ডের জন্য এই মেয়ে গত ক’টা মাস ধরে হেঁটে আসে ক্যাম্পাস। ধমকালাম আমি।
‘তুমি দুনিয়ার গল্প উপন্যাস পড়ো। এমন বইপড়ুয়া মানুষ বুঝি এত গাধা হয়? আমার সঙ্গে একটিবার কথা বলবা না এটা নিয়ে?’
‘কী নিয়ে?’
‘কে বলেছে তোমায় বই বের করার জন্য লেখকের টাকা খরচ করতে হয়?’
‘আমার বান্ধবীরা বলল।’
আমি ক্যাম্পাসের এক কোণায় সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বোকা মানবীর গালে হাত রেখে আদুরে স্বরে বললাম, ওসব কিচ্ছু লাগে না আফরিন। আমার পকেট থেকে খুচরো পয়সা খরচ করেও আমি বই প্রকাশ করবো না কোনোদিন। আমি প্রকাশক না। লেখক। লেখকদের জন্য প্রকাশনী, প্রকাশনীর জন্য লেখক নয়। তুমি বুঝতে পারছো আমার কথা?
‘কিন্তু এখন এতগুলো টাকা জমালাম। কী করবো?’
অমন নিষ্পাপ মুখচ্ছবি তার, আর কী অদ্ভুত ওই ঝামেলা! আমি হেসে ফেললাম। বললাম, রোজ রিকশা করে আসবা এখন থেকে। যা যা এতদিন বাদ দিয়ে ওই টাকা জমিয়েছো, তাতে খরচ করবা। আর এমন বোকামো করবা না।
.
আমি যেমন আফরিনের কোনো মতামত পাত্তা দিই না। আফরিনও দেয় না আমার। অতকিছু বুঝিয়ে বলার পরও তাকে আমি দেখতাম, সকাল বেলা ব্যাগ কাঁধে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে আসছে ফুটপাত ধরে। চুল খোলা। কপালে ঘাম। জিজ্ঞেস করলে বলতো, হেঁটে হেঁটে অভ্যাস হয়ে গেছে। না হাঁটলে অস্বস্তি লাগে খুব। আফরিন এক আশ্চর্য মানবী। এবং অতিমাত্রায় সংসারী। আমার প্রথম উপন্যাস দশ কপি কিনবে সে ওই জমানো টাকা দিয়ে। যেগুলো খরচ করা হয়নি এখনও।
‘দশ কপি কিনে কী করবা?’
‘আমার বান্ধবীদের উপহার দেবো।’
‘ওরা তো বই পড়ে না।’
‘এইজন্য উপহার দেবো। উপহার দিলে মানুষ বই পড়ে। বই পড়ার একটা দায় থেকে যায়।’
‘তবে আমার বন্ধুদের উপহার দাও বই। জোর করে পড়ানো লাগবে না। কোনোরকম দায়-ফায় ছাড়া আমার বন্ধুরা বই পড়ে।’
‘না। ওরা কি আমায় উপহার দিয়েছে কোনোদিন?’
আমি অতঃপর বুঝলাম, বান্ধবীদের উপহার দেওয়ার কারণ। মোটেও বই পড়ানো নয়। আমার বই আফরিনের নিকট একটা গর্ব। ওর বান্ধবীরা যখন তাদের ভালোবাসার মানুষটির কর্পোরেট চাকুরি, অমুক জায়গায় চাকুরি, তমুক জায়গার ব্যবসা নিয়ে আলাপ দেয়, আফরিন তখন ছোট্ট করে শুধু বলে, তার ভালোবাসার মানুষটি লেখে। কী লেখে? গল্প। শুধুই গল্প? উহু, উপন্যাসও। বেশ চমৎকার উপন্যাস। না পড়েও আফরিন জানে, ওই দীর্ঘ গল্পের প্রতিটি পৃষ্ঠায় গভীরতম অনুভূতি ঠাসা। ওটি একটা সম্পদ। শুধুমাত্র আফরিন জানে কতটা মূল্য তার। আমার বই বের হলে আফরিন ওদের উপহার দেবে তা। তখন ওরা জানবে, লিখালিখি একটা মারাত্মক ক্ষমতা। ক্যালকুলেটরের বাটনে দু’বার প্রেস করে কষা বিরাট অংক কিংবা গুদামে জমে যাওয়া অজস্র বস্তার লিফো ফিফো মেথড-এর মতোনই আরেকটা চমৎকার ক্ষমতা। ওই ক্ষমতা তার ভালোবাসার মানুষটির খুব ভালো করেই বিদ্যমান।
দশ কপি উপহারের পেছনে আরও একটা কারণ বিদ্যমান। প্রায় বিশেষ দিবসেই আফরিন উপহার পেয়েছে অল্প-স্বল্প, বান্ধবীদের নিকট থেকে। কখনই দেওয়া হয়নি কিছু। আফরিন ওদের দেবে তার সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। বই। আমার মুখে উপন্যাস লিখা আরম্ভ হওয়ার সংবাদ শুনে তাই আফরিনের হাস্যোজ্জল মুখচ্ছবি আমার কাছে পরিষ্কার। পাশাপাশি আমি লক্ষ করলাম তার আচার-আচরণও বেশ পাল্টেছে আচমকা। আগে ফোনের পর ফোন দিয়ে বিরক্ত করতো খুব। ওই বিরক্তি অবশ্য আমি উপভোগ করতাম। সেদিন আমায় রুমে বসে লিখতে দেখে পাশে চেয়ার টেনে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আঙুল দিয়ে আলতো করে খোঁচালো। আমি কী-বোর্ড রেখে তাকাতেই জিজ্ঞেস করল, তোমায় আমি কি ফোন কম দেবো এখন?
‘কেন?’
‘তোমার কি লেখার সমস্যা হবে?’
আমি কী-বোর্ডে ফেরত গেলাম পুনরায়। টাইপ করতে করতে বললাম, লেখালিখির সময় পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও আমি বিরক্ত হই। তুমি কিভাবে বুঝবে আমি লিখছি নাকি লিখছি না?
‘তুমি যখনই লিখবে না, আমায় ফোন দিয়ো।’
‘আচ্ছা।’
ও কথার কথা। আমি নিজ থেকে খুব কম ফোন দিতাম তাকে। ওটা আমার রুঢ়তা নয়। আমি জানতাম ওর সারাটিক্ষণ কতটা অক্লান্ত পরিশ্রমে কাটে। সকাল বেলা টিউশনি, সেখান থেকে ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাস থেকে টিউশনি, তারপর বাসা, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ফের টিউশনি, রাত্তিরে বাসায় ফিরে বাসায় একটা টিউশনি শেষে খেয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে সাড়ে এগারটা। তখন ওর চোখভর্তি থাকে ঘুম। গলার স্বর জড়িয়ে যায়। চোখের কোণায় তা চেপে ধরে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে সে। অনেকক্ষণ। সারাদিন আমি নিজ থেকে ফোন দিই না তাই। কথা বলাও একটা পরিশ্রম। যখন আমি উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম, তখন আমাদের কথা হলো দিনে শুধু একবার করে। রাত সাড়ে এগারটায়। বারোটা অবধি। এক রাতে ঘুম ঘুম স্বরে আফরিন বলল, তোমার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি প্রথম পড়বো আমি।
‘হ্যাঁ। তুমি পড়বে। তারপর একগাদা ভুল ধরিয়ে দিয়ে আমায় অতলে ডুবিয়ে দেবে।’
ফোনের ওপাশ থেকে খিলখিল ভেসে আসলো।
‘আমি বাদে তুমি সবার সমালোচনা নাও। আমি সমালোচনা করলে ক্ষতি কী?’
‘জানি না।’
‘তুমি আমায় অনেক ভালোবাসো?’
‘না।’
পুনরায় খিলখিল ভেসে আসলো।
‘আমিও তোমায় বাসি না।’
‘ঘুমাবে কখন?’
‘তুমি বুঝি লিখতে বসবে আবার?’
‘হ্যাঁ।’
‘কয়টা পর্যন্ত লিখবে?’
‘ঠিক নেই আফরিন। তোমার গলা ঘুমে ডুবে আছে। তুমি ঘুমাও।’
‘আমি তোমায় শুনবো।’
‘ফোনের টাকা যাচ্ছে।’
‘আজ ফ্রি টকটাইম পেয়েছি। ভোর পর্যন্ত।’
আমি আঁতকে উঠলাম।
‘মানে কী? ভোর পর্যন্ত জেগে থাকবে?’
‘মাথা খারাপ নাকি? ভোর পর্যন্ত জাগতে যাবো কেন? তুমি ফোনটা তোমার কী-বোর্ডের পাশে রেখে দাও। আমি খটর খটর শুনতে শুনতে ঘুমাবো।’
আফরিন এক আশ্চর্য মানবী। কতরকম পাগলামো যে তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল, আমি ছাড়া আর কেউ জানতো না তা। আমি ফোনখানা কান থেকে নামিয়ে কী-বোর্ডের পাশে রাখলাম। লিখতে শুরু করলাম। ঘুমের সময় সামান্য ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজেও বিরক্তি আসে আমার। অথচ আফরিন ওই বিচ্ছিরি খটর-খটর শুনতে শুনতে ঘুমালো। তার নিকট ওটা স্বর্গীয় আওয়াজ। অপার্থিব ঘুম। আমারও যদি অমন একটা ঘুম হতো। হয়নি। উপন্যাসটা শেষ হওয়ার জন্য আমার লেগেছিল দীর্ঘ সময়। চার বৎসর। ওই চার বৎসরে আমার একটা সেমিস্টার লস, শরীরের বারোটা বাজানো, চোখের নিচে গর্ত পড়া, অকারণে মেজাজ বিগড়ে থাকা এমনকি একদিন আফরিনকে একটা থাপ্পড় দেওয়াও বিদ্যমান ছিল।
.
আফরিনের দোষ ছিল না। উপন্যাস শেষের দিকে তখন। গল্পের একটা চরিত্র একটা ভয়াবহ দ্বন্দ্বের সামনে দাঁড়িয়ে। তার সামনে দুইজন মানুষ। অমন একটা পরিস্থিতি, তখন তাকে বেছে নিতে হচ্ছে একজন মাত্র মানুষ। সে দাঁড়াতে পারবে একজনের পাশে। অথচ দুইজনই তার একান্ত আপনজন। চরিত্রের স্বভাব অনুযায়ী সে ডানপাশ বেছে নেবে। আমিও অমন করেই তৈরী করছিলাম। কিন্তু ডানপাশ বেছে নিলে চরিত্রটা তার নায়কোচিত ইমেজ হারাবে। ওটি প্রধান চরিত্র। আমরা কখনই কোনো উপন্যাস গল্পের প্রধান চরিত্রটাকে অমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করি না, যেখানে তার চিরাচরিত মানবতা, সদগুণ, পরিচ্ছন্ন ও শুভ্রদিকটা হারাবে সে। পাঠক চায় সব গল্পেই হিরো জিতুক। মানবতার যদিও আকাল, তবুও প্রতিটা গল্পের নায়ক প্রমাণ করে যায়- মানবতাই সত্য।
আমার মধ্যে চলছিল দারুণ অন্তর্দ্বন্দ্ব। গল্প চাচ্ছে ডানপাশ। পাঠক চাচ্ছে বামপাশ। ল্যাপটপে ওয়ার্ড ফাইলটা খুলে রুমে রেখে মাথার দুই পাশে হাত দিয়ে চেপে বারান্দায় বসে রইলাম আমি। আফরিন পা টিপে টিপে রুমে ঢুকে টেবিলের পাশ থেকে কোনো একটা বই নিতে চাইলো। বইয়ের শক্ত কভারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে খুলে রাখা ল্যাপটপ ধপাস করে পড়ল নিচে। স্ক্রিন ভেঙে চৌচির। ল্যাপটপের পেছন থেকে ধোঁয়া বের হলো। আর পোড়া গন্ধ। আমি আচমকা শব্দ পেয়ে রুমে ঢুকে দেখলাম, আফরিন থতমত খাওয়া মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে। ল্যাপটপ নিচে পড়ে আছে। স্ক্রিন ভাঙা। ধোঁয়া আসছে ওখান থেকে অল্প। আফরিন আমার দিকে তাকিয়ে ভীত স্বরে বলল, খেয়াল করিনি।
আমি থমথমে স্বরে বললাম, উপন্যাসটা কি পাবো আমি আর?
‘তুমি কোথাও সংগ্রহে রাখোনি ফাইল? ড্রাইভে রাখোনি?’
‘না।’
আফরিনের চোখে ভীতি জমাট বাঁধলো মুহূর্তেই। সে ভাঙাচুরা ল্যাপটপ কুড়িয়ে নিতে শুরু করল। আর কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, কী বলো তুমি? এটা এখন রিপেয়ার করলে ওয়ার্ড ফাইলগুলো থাকবে না?
‘জানি না।’
‘অবশ্যই থাকবে। এখন তথ্য প্রযুক্তি কত উন্নত। অত সহজে কি ফাইল নষ্ট হয়?’
আফরিন সঠিক ছিল না। আজকালকার তথ্য প্রযুক্তি উন্নত হলেও আমার ল্যাপটপ ছিল বেশ পুরাতন। রিপেয়ার করাতে যেয়ে জানা হলো, আমার চার বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আমি আর ফেরত পাচ্ছি না। যেহেতু চার বৎসর ধরে বোকার মতোন শুধু লিখেই গিয়েছি, আর কোথাও ওই ফাইল রাখা হয়নি, তাই কোথাও থেকে সংগ্রহ করার সম্ভাবনাও শূন্য। মাথা ফাঁকা হয়ে এলো আমার। চারপাশ অমন চুপসানো লাগলো, দম আটকে আসলো প্রায়। আফরিন রিপেয়ার দোকানের দরজায় আমার দিকে থতমত খাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভীষণ অপরাধী মুখ করে বলল, তুমি ফাইলটা যদি একটা ড্রাইভে নিয়ে রাখতে।
কথা শেষ হওয়ার আগে আমি জোরদার থাপ্পড় বসালাম তার গালে। প্রচণ্ড জোরে। শুকনো শরীর তার, কতই বা আর ওজন। থাপ্পড় খেয়ে বামদিকে হেলে পড়তে যেয়েও দরজার কাঁচ ধরে সামলালো নিজেকে কোনোরকম। ফর্সা বাম গালে আমার হাতের তালু স্পষ্ট। আমি রাগে অন্ধকার দেখলাম চোখে। আমার চার বৎসরের পরিশ্রম নষ্ট করেও আফরিন আমায় একটিবার স্যরি না বলে উল্টো আমারই কাঁধে চাপাতে চাইছিল যেন দোষটা। কেন আমি ওই ফাইল কোথাও নিয়ে রাখিনি? দোষ আমার!
আফরিনের হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গিয়েছিল নিচে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ওটা উঠিয়ে একবার দোকানের ভেতর তাকালো আড়চোখে সে। সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু সে খোদ। আমি পাথরের মতোন দাঁড়িয়ে। আফরিন আমার চোখের দিকেও তাকালো একবার। তার চোখজোড়া লাল। স্বচ্ছ জলে টলটল। ঢোক গিলল কয়েকবার। কিছু বলতে যেয়েও বলল না। থরথর করে কাঁপতে থাকা নিচের ঠোঁটখানা কামড়ে ধরে বোধহয় জল আটকালো চোখের। অমন লজ্জা। অতগুলো মানুষ চারপাশে। আর হয়তোবা অপরাধবোধও হলো খুব। আর কেউ না জানুক, সে তো জানে নিজ হাতে নষ্ট করা ওই ফাইলের পেছনে আমার কতটুকুন ত্যাগ বিদ্যমান। চার-চারটা আস্ত বৎসর। নিমিষেই জলে গেল সব। টু শব্দও না করে আফরিন ব্যাগ হাতে জড়িয়ে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে দোকান থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় টললও অল্প। দরজার কাঁচ ধরে সামলালো আরেকবার নিজেকে। আফরিন দোকান থেকে বের হয়ে যাওয়ার অনেকটা সময় পরও আমি দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম স্থির। আচমকা মনে হয়েছিল, আমার গন্তব্য ফুরিয়েছে। আমি কোথাও এসে পৌঁছে গেছি। ওই গন্তব্য আমি চাইনি কোনোদিন। আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই।
.
পাঁচ বৎসর আগে এক বইমেলায় আমায় একটা কলম উপহার দিয়েছিল আফরিন। পাঁচ বৎসর পর বইমেলা শুরু হলো আরেকবার। আজ ফেব্রুয়ারির এক তারিখ। আমার উপন্যাস লেখা শেষ। ওই ফাইল আমি কোথাও পাইনি। কিন্তু মগজে গেঁথে ছিল পুরো গল্প। ওটি সাজিয়ে আরেকবার লিখতে লাগলো একটি বৎসর মাত্র।
ওই একটি বৎসর আমি চারপাশ থেকে আড়াল রইলাম। আড়াল নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। আমি একটানা লিখে গেলাম। আমায় বিরক্ত করার কেউ ছিলও না। আমায় বিরক্ত করার জন্য কিংবা পুনরায় মাথায় রাগ চড়িয়ে দেওয়ার জন্য আফরিন ওইদিন লাল একখানা মুখ নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরত যায়নি আর। অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় ওর গায়ের উপর চড়ে গিয়েছিল বারো টন ওজনের একটা ট্রাক। ওর বুকের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল একজোড়া শক্ত চাকা। পিচ রাস্তায় পাঁজর ভেঙে বুকে বসে গিয়েছিল জোড়া টায়ারের ছাপ। ওর রক্তে ভেসে গিয়েছিল শ্রীপুর গোলচত্বরের পার্শ্ববর্তী ড্রেন।
একটুক্ষণ সময় পায়নি আফরিন। যদি সময় পেতো বাঁচার, তবে স্পষ্ট দেখতো চোখে জল নিয়ে তার অর্ধেক ভাঙ্গচুর দেহ স্ট্রেচারে নিয়ে হসপিটালের ইমার্জেন্সী রুমের দিকে ছুটে যাচ্ছে এক ভীত যুবক। যার আশঙ্কা, বিদায়ের আগমুহূর্তে লালচে ওই গালে একটা চুমু দেওয়া হবে না তার আর। প্রচণ্ড ভালোবাসার মানুষটি বিদায় নেবে ভয়ংকর একটা মুহূর্তের সম্মুখীন হয়ে, ভয়ংকর একটা সত্য জেনে- সে নষ্ট করেছে চার বৎসরের পরিশ্রম। তার অন্ততপক্ষে জানা উচিত, ওই চার বৎসর কিছুই নয়, বৎসর চুলোয় যাক, সে থাকুক পাশে। এইটুকুন তার জানা দরকার ছিল, যুবক ডুবে যাচ্ছে তখন অতলে। তার জন্য। যুবক কোনোদিন আর মাথা তুলতে পারবে না। আফরিনের ওসব কিচ্ছুটি জানা হয়নি। সে মরে গিয়েছিল রাস্তায়। ভয়াবহ লজ্জা আর ভীষণ অপরাধবোধে ভুগে। বেঁচে থাকলে আজ দারুণ খুশি হতো। আমার বই প্রকাশ হলো অতঃপর। উৎসর্গ পত্রে লেখা, ‘কাউকে না’।
আমি আফরিনকে ওই বই উৎসর্গ করিনি। জানি না কেন। হয়তোবা এক ভীষণ ক্ষোভ। আমার প্রবল রাগ জমা তখনও। আফরিনের উপর। আমায় একটা বারো টন ভারী ওজনের পাথরের তলায় চাপা দিয়ে গিয়েছে সে। ওখান থেকে মু্ক্ত হওয়ার উপায় জানা নেই আমার। মুক্ত হওয়ার জন্য বইমেলায় ভীষন হট্টগোলের ভেতর আমি ঘুরে বেড়াই একা একা। হাঁটি মেলার এইপাশ থেকে ওইপাশ, সকাল থেকে সন্ধ্যা। আমার সঙ্গে হাঁটে একটা সদ্য প্রকাশ হওয়া বই। আর একটা ইকোনো কলম।

error: Content is protected !!