বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪, ১৮ আশ্বিন, ১৪৩১
Live TV
সর্বশেষ

Sabrina Mishti Husain

একজন অবন্তিকা

Sabrina Mishti Husain
২২ মার্চ, ২০২৪, ৪:১৬ অপরাহ্ণ | 168
একজন অবন্তিকা
২২ মার্চ, ২০২৪, ৪:১৬ অপরাহ্ণ | 168

একজন অবন্তিকা (কেউ হয়তো মরে গিয়ে বেঁচে যায়, কেউ বেঁচে মরে থাকে)

“ভাংতি নাই আফা, ভাংতি দেন”রিক্সাওয়ালা তাড়া দেয় ! ব্যস্ত হাতে ব্যাগের মধ্যে হাতড়ে ভাংতি খুঁজতে গিয়ে যাবতীয় জিনিস হাতে ঠ্যাকে! এই ব্যাগ দুনিয়ার জিনিসে ভর্তি – ঘরের চাবি থেকে পানির বোতল , ভেজা টিস্যু থেকে শুরু করে লিপস্টিক ,আয়না,চিরুনি;প্যারাসিটামল থেকে শুরু করে টেইলারস এর রিসিট – কি নেই ??? শুধু ভাংতির সন্ধান মেলে না! এদিকে সময় পার হয়ে যাচ্ছে ! দীর্ঘ অবসর সময় কখনও ফোন বাজেনা, অথচ যখন খুব অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে থাকে তখনই বেয়াড়া মোবাইলটা ক্রমাগত বাজতে থাকে, এটা সামিরা সবসময় লক্ষ্য করেছে,এত সকালে কে এতবার কল দেয় ? নিশ্চিত কোন রোগী! তাড়াহুড়া করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রিসিভ করতে গিয়ে আয়না, লিপস্টিক, চুলের ক্লিপ , চিরুনি সব রিক্সার পাদানিতে ছিটকে পরলো! উফ! আজ দিনটাই খারাপ !
এমনসময় ঔষধ কম্পানির এক রিপ্রেজেনটেটিভ ছুটে এলো! এতক্ষন দূরে দাড়িয়ে সে মনোযোগ দিয়ে সামিরাকে লক্ষ্য করছিলো! কাছে এসেই সালাম দিয়ে রিক্সার পাদানি থেকে জিনিসগুলো কুড়িয়ে সামিরার হাতে দিতে দিতে বলে, “ভাড়া কত, ম্যাডাম?”সামিরা অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “না,না, আপনি কেন দিবেন ?”যান, ম্যাডাম,আমি দেখছি!
সামিরা আর কথা বাড়ায় না, ওয়ার্ড রাউন্ড মনে হয় শুরু হয়ে গেছে- সে তিনতলার মেডিসিন ওয়ার্ড এর দিকে দৌড়ায় – দু’তিন সিঁড়ি টপকে টপকে যখন হাঁফাতে হাফাতে পৌঁছায় তখন দেখে ইত:মধ্যে রাউন্ড শুরু হয়ে গেছে ! “কি ম্যাডাম, আজও লেট? এমবিবিএস পাশ করলেই ডাক্তার হওয়া যায়না! রূপচর্চা করেই তো সময় পাননা, রোগী দেখবেন কথন? বিশেষজ্ঞ হওয়া কি হাতের মোয়া?”চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন ইউনিট প্রধান অধ্যাপক রায়হান ! অপমানে সামিরার চোখে পানি এসে যায়! অধ্যাপক স্যার দিনের মধ্যে অন্তত বিশ বার তাকে মুঠোফোনে এসএমএস পাঠান- সেখানে সামিরার রূপ যৌবনের ভূয়সী প্রশংসা থাকে, আরও থাকে গদগদ টাইপের কিছু স্বরচিত নিম্নমানের প্রেমের কবিতা ! সকালে স্যারের রুমে খাতা সই করতে গেলে অথবা কোন রোগীর ট্রিটমেনট প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করতে গেলে রুমে কেউ না থাকলে অত্যন্ত সাবধানে অসাবধান হবার ভান করে শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা করেন! বহুবার সামিরাকে নিয়ে কফিশপে যাবার ব্যকুলতা তিনি প্রকাশ করেছেন! অথচ সবার সামনে এ কেমন ব্যবহার !
সামিরা কোন উঁচ্চবাচ্য করেনা, আবার মুখ ফুটে অপমানজনক কিছু বলতেও পারেনা! তার বাৎসরিক এসিআর স্যারই দিবেন, ট্রেনিং সার্টিফিকেটও তিনিই দেবেন! সামিরার থিসিসের গাইডও উনি! এই শেষ সময়ে গাইড পরিবর্তন অসম্ভব! তাই,স্যারের প্রস্তাব সে বুঝেও না বোঝার ভান করে মুখ বুজে থাকে !
অফিস শেষে মেজাজ খারাপ করে বাসায় ফেরে সামিরা, রাস্তায় অনেক ট্রাফিক ছিলো, প্রায় চারটা বেজে গেছে! আজও নিশ্চিত শাশুড়ির কটুকথা শুনতে হবে! হলোও তাই, শাশুড়ি মনোয়ারা বেগম মনে হয় তৈরী হয়েই ছিলেন! ঘরে পা রাখার সাথে সাথে চড়াও হলেন,”কোথায় ছিলা এতক্ষণ?সরকারী হাসপাতালে একটার পর আর কোন ডাক্তার থাকে? আমাকে শিখাইতে আসো? আমার বড় ফুপার ছোটভাইও সরকারী ডাক্তার ছিলো! একটার পর এই তিন ঘন্টা অন্য ডাক্তারদের সাথে হাসাহাসি ঢলাঢলি করতেসিলা, আমার সব জানা আছে! তোমরা ডাক্তারনিরা কি করো, জানিনা মনে করসো? আর একটু সাদা চামড়া হলে তো কথাই নাই!”দিনের মধ্যে যতবারই সামিরা শাশুড়ির সামনে পরে ততবারই তিনি কায়দা করে সাদা চামড়ার খোঁচা দেন এবং বলেন, সাদা চামড়া মানেই সুন্দরী না- তার মেয়েরা তো শ্যামলা কিন্তু কত মিষ্টি চেহারা ইত্যাদি, ইত্যাদি! অন্যদিন সামিরাও ক্যাটক্যাট করে জবাব দেয় , আজ আর কিছু বলেনা-বড্ড ক্লান্ত লাগছে! ঘামে ধূলায় শরীর, চুল আঠা আঠা!
রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে সামিরা! পাশেই স্বামী মুন্না মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ! কত কাছাকাছি আছে দু’জন তবুও কাছে নেই, দৈহিকভাবে তো যখন তখন জড়িয়ে ধরতে পারে কিন্তু জড়িয়ে রাখার মানসিকতা কবেই হারিয়ে গেছে! স্বামীর চলাফেরা , ঘোরাঘুরি নিয়ে কখনও প্রশ্ন করেনা সে, জানে, ছাড় না দিলে ছাড়াছাড়ি হবে।”এত মেসেজ কাকে করো? আসোনা একটু গল্প করি!”মুন্না মহাবিরক্ত হয়ে জবাব দেয়,”সব তোমাকে বলতে হবে? সারাদিনরাত হাসপাতালে পরে থাকো,কি করো তোমাকে জিজ্ঞেস করি ?” ভাব দেখে মনে হয় হাসপাতালে সামিরা কাজ করতে যায়না, ফূরতি করতে যায়! সামিরা বোঝে, স্বামীর সাথে আলাপ করে লাভ নেই ! তাদের দুজনের আমেরিকার ভিসা হয়েছে! শিকাগোর একটা কনফারেন্স এ পেপার প্রেজেনট করবে সামিরা! ছুটির দরখাস্ত নিয়ে স্যারের পেছন পেছন ঘুরছে গত দুসপ্তাহ যাবত – তিনি বিভিন্ন টালবাহানায় সই করছেন না! এরপর আর ছুটি মঞ্জুরের সময় থাকবেনা কারন মন্ত্রনালয়ের আদেশ হতেও বেশ কিছুদিন লাগবে! আগামীকাল স্যার বিকেল সাড়ে তিনটায় দরখাস্ত নিয়ে তার রুমে যেতে বলেছেন! ঐ সময়টা তিনতলার কোনার বিশাল রুমটা একদম ফাঁকা থাকে! কেন তিনি এসময় সামিরাকে ডেকেছেন কারনটা একেবারেই স্পষ্ট! অস্থির লাগছে একারনেই!
পরদিন বিকেল সাড়ে তিনটা,সামিরা রুমের সামনে গত ১ ঘন্টা ধরে দরখাস্তের কপি আর বাৎসরিক এসিআর নিয়ে দাড়িয়ে আছে! স্যার রুমে নেই, তিনি মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়েছেন অধিদপ্তরে জরুরী মিটিং এ আছেন! সামিরা যেন অপেক্ষা করে ! চারটার সময় স্যারের রুমের পিয়নটা বলে, “আফা আমি যাই ! বেইল পইরা গেসে! আফনে যাইবেন না?” সামিরা দোটানায় পরে যায়, আজ সই না করলে কাল একমাত্র কার্য দিবস, এরপর দুইদিন শুক্র শনি আর বৌদ্ধ পূরণিমার ছুটি মিলিয়ে মোট তিনদিন বন্ধ থাকবে! যাওয়াটাই ক্যানসেল হয়ে যাবে!
পিয়ন চলে যাওয়ায় পুরো বারান্দা ফাঁকা ! ঘামতে থাকে সামিরা! এমনসময় স্যারকে আসতে দেখা যায়! ভেতরে এসো – স্যারের চকচকে চোখে স্পষ্ট আহ্বান !সামিরার পা দু’টো পাথরের মতো ভারী ! নি:শ্বাস দ্রুত পরছে -কি করবে সে ???? ছুটে পালিয়ে যাবে ? নাকি পার হয়ে যাবে নৈতিকতা আর সতীত্বের লক্ষণরেখা ? কি করবে সামিরা ?????

(আমার লিখা প্রথম ছোট গল্প- অনেক নির্যাতিত অবনতিকার জন্য)