শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৬ আশ্বিন, ১৪৩১
Live TV
সর্বশেষ

ابن سینا رحمہ اللہ ইবনে সিনা(সংক্ষিপ্ত জীবনী) (৯৮০-১০৩৭ খ্রিঃ)

দৈনিক দ্বীনের আলোঃ
২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৬:২৪ অপরাহ্ণ | 30
ابن سینا رحمہ اللہ  ইবনে সিনা(সংক্ষিপ্ত জীবনী) (৯৮০-১০৩৭ খ্রিঃ)
২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৬:২৪ অপরাহ্ণ | 30

✒️মুহাম্মদ শেখ বাহাউদ্দিন

খলিফা :আল্লামা আয়াজ আহম্মেদ যোবায়েরী খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিনিধি

যিনি কঠোর জ্ঞান সাধনা ও অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে ছিলেন সারাটা জীবন, এক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ধন-সম্পদ, ভোগ বিলাস ও প্রাচুর্যের মোহ যাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, যিনি ছিলেন মুসলমানদের গৌরব তিনি হলেন ইবনে সিনা। তাঁর আসল নাম আবু আলী আল্ হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। তিনি সাধারণত ইবনে সিনা, বু-আলী সিনা এবং আবু আলী সিনা নামেই অধিক পরিচিত।

৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কীস্থানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম সিতারা বিবি। পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন খোরাসানের শাসনকর্তা। জন্মের কিছুকাল পরই তিনি ইবনে সিনাকে বোখারায় নিয়ে আসেন এবং তাঁর লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করেন। ছোটোবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে লুকিয়ে ছিলো অসামান্য মেধা ও প্রতিভা। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্থ করে ফেলেন। তাঁর ৩ জন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ইসমাইল সুফী তাঁকে শিক্ষা দিতেন ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ শাস্ত্র ও তাফসীর; মাহমুদ মসসাহ শিক্ষা দিতেন গণিত শাস্ত্র এবং বিখ্যাত দার্শনিক আল্ না’তেলী শিক্ষা দিতেন দর্শন, ন্যায় শাস্ত্র, জ্যামিতি, টলেমির আল মাজেস্ট, জওয়াহের মান্তেক প্রভৃতি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে সকল জ্ঞান তিনি লাভ করে ফেলেন। বিখ্যাত দার্শনিক আল্ না’তেলী’র নিকট এমন কোনো জ্ঞান আর অবশিষ্ট ছিলো না, যা তিনি ইবনে সিনাকে শিক্ষা দিতে পারবেন। এরপর তিনি ইবনে সিনাকে নিজের স্বাধীন মতো গবেষণা দেন।

এবার তিনি চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কিত কিতাব সংগ্রহ করে গবেষণা করতে শুরু করেন।ইবনে সিনা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, এমন বহু দিবারাত্রি অতিবাহিত হয়েছে যার মধ্যে তিনি ক্ষণিকের জন্যেও ঘুমাননি। কেবলমাত্র জ্ঞান সাধনার মধ্যেই ছিলো তাঁর মনোনিবেশ। যদি কখনো কোনো বিষয় তিনি বুঝতে না পারতেন কিংবা জটিল কোনো বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখনই তিনি মসজিদে গিয়ে নফল নামাজ আদায় করতেন এবং সেজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে বলতেন,” হে আল্লাহ তুমি আমার জ্ঞানের দরজাকে খুলে দাও।জ্ঞান লাভ ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কোনো কামনা নেই।” তারপর গৃহে এসে আবার গবেষণা শুরু করতেন। ক্লান্তিতে যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো স্বপ্নের ন্যায় তাঁর মনের মধ্যে ভাসতো এবং তাঁর জ্ঞানের দরজা খুলে যেতো। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেই সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে যেতেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসা বিদ্যায় ইন্দ্রজালের সৃষ্টি করে বাদশাহকে সুস্থ করে তোলেন। বাদশাহ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর জন্য রাজ দরবারে কুতুবখানা উন্মুক্ত করে দেন। মাত্র অল্প কয়েকদিনে তিনি অসীম ধৈর্য্য ও একাগ্রতার সাথে কুতুবখানার সব কিতাব মুখস্থ করে ফেলেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোনো বিষয় বাকি ছিলো না যা তিনি জানেন না। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদতত্ত্ব, চিকিৎসা শাস্ত্র, কাব্য সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন। ২১ বছর বয়সে ‘আল মজমুয়া’ নামক একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন, যার মধ্যে গণিত শাস্ত্র ব্যতীত প্রায় সকল বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছিলেন।Join now
Sign in
আজকের বিষয়ঃ ইবনে সিনা(সংক্ষিপ্ত জীবনী) (৯৮০-১০৩৭ খ্রিঃ)।

যিনি কঠোর জ্ঞান সাধনা ও অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে ছিলেন সারাটা জীবন, এক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ধন-সম্পদ, ভোগ বিলাস ও প্রাচুর্যের মোহ যাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, যিনি ছিলেন মুসলমানদের গৌরব তিনি হলেন ইবনে সিনা। তাঁর আসল নাম আবু আলী আল্ হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। তিনি সাধারণত ইবনে সিনা, বু-আলী সিনা এবং আবু আলী সিনা নামেই অধিক পরিচিত।

৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কীস্থানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম সিতারা বিবি। পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন খোরাসানের শাসনকর্তা। জন্মের কিছুকাল পরই তিনি ইবনে সিনাকে বোখারায় নিয়ে আসেন এবং তাঁর লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করেন। ছোটোবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে লুকিয়ে ছিলো অসামান্য মেধা ও প্রতিভা। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্থ করে ফেলেন। তাঁর ৩ জন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ইসমাইল সুফী তাঁকে শিক্ষা দিতেন ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ শাস্ত্র ও তাফসীর; মাহমুদ মসসাহ শিক্ষা দিতেন গণিত শাস্ত্র এবং বিখ্যাত দার্শনিক আল্ না’তেলী শিক্ষা দিতেন দর্শন, ন্যায় শাস্ত্র, জ্যামিতি, টলেমির আল মাজেস্ট, জওয়াহের মান্তেক প্রভৃতি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে সকল জ্ঞান তিনি লাভ করে ফেলেন। বিখ্যাত দার্শনিক আল্ না’তেলী’র নিকট এমন কোনো জ্ঞান আর অবশিষ্ট ছিলো না, যা তিনি ইবনে সিনাকে শিক্ষা দিতে পারবেন। এরপর তিনি ইবনে সিনাকে নিজের স্বাধীন মতো গবেষণা দেন।

এবার তিনি চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কিত কিতাব সংগ্রহ করে গবেষণা করতে শুরু করেন।ইবনে সিনা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, এমন বহু দিবারাত্রি অতিবাহিত হয়েছে যার মধ্যে তিনি ক্ষণিকের জন্যেও ঘুমাননি। কেবলমাত্র জ্ঞান সাধনার মধ্যেই ছিলো তাঁর মনোনিবেশ। যদি কখনো কোনো বিষয় তিনি বুঝতে না পারতেন কিংবা জটিল কোনো বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখনই তিনি মসজিদে গিয়ে নফল নামাজ আদায় করতেন এবং সেজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে বলতেন,” হে আল্লাহ তুমি আমার জ্ঞানের দরজাকে খুলে দাও।জ্ঞান লাভ ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কোনো কামনা নেই।” তারপর গৃহে এসে আবার গবেষণা শুরু করতেন। ক্লান্তিতে যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো স্বপ্নের ন্যায় তাঁর মনের মধ্যে ভাসতো এবং তাঁর জ্ঞানের দরজা খুলে যেতো। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেই সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে যেতেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসা বিদ্যায় ইন্দ্রজালের সৃষ্টি করে বাদশাহকে সুস্থ করে তোলেন। বাদশাহ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর জন্য রাজ দরবারে কুতুবখানা উন্মুক্ত করে দেন। মাত্র অল্প কয়েকদিনে তিনি অসীম ধৈর্য্য ও একাগ্রতার সাথে কুতুবখানার সব কিতাব মুখস্থ করে ফেলেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোনো বিষয় বাকি ছিলো না যা তিনি জানেন না। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদতত্ত্ব, চিকিৎসা শাস্ত্র, কাব্য সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন। ২১ বছর বয়সে ‘আল মজমুয়া’ নামক একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন, যার মধ্যে গণিত শাস্ত্র ব্যতীত প্রায় সকল বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

১০০১খ্রিষ্টাব্দে ইবনে সিনার পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিলো ২২ বছর। নেমে আসে তাঁর উপর রাজনৈতিক দুর্যোগ। তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হন এবং ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে ইবনে সিনা খাওয়ারিজমে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সময়ে খাওয়ারিজমের বাদশাহ ছিলেন মামুন বিন মাহমুদ। ১০০৪-১০১০ খ্রিঃ পর্যন্ত তিনি খাওয়ারিজমে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করলেও তাঁর এ সুখ শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ইবনে সিনার সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে গজনীর সুলতান মাহমুদ তাঁকে পেতে চাইলেন। কারণ মাহমুদ জ্ঞানী ব্যক্তিদের খুব ভালোবাসতেন। তাঁদেরকে দেশ বিদেশ থেকে ডেকে এনে তাঁর শাহী দরবারে গৌরব বৃদ্ধি করতেন এবং তাঁদেরকে মণি-মুক্তা উপহার দিতেন। এতদুদ্দেশ্যে সুলতান মাহমুদ তাঁর প্রধান শিল্পী আবু নসরের মাধ্যমে ইবনে সিনার ৪০ খানা প্রতিকৃতি তৈরি করে সমগ্র পারস্য ও এশিয়া মাইনরের রাজন্যবর্গের নিকট ছবিসহ পত্র পাঠিয়ে দিলেন যাতে তাঁরা ইবনে সিনাকে খুঁজে বের করতে পারেন। দেশে বিদেশে সুলতান মাহমুদ লোক পাঠিয়ে দিলেন।এছাড়া তিনি খাওয়ারিজমের বাদশাহ মামুন বিন মাহমুদকে পরোক্ষভাবে এ নির্দেশ দিয়ে একটি পত্র পাঠালেন যে, তিনি যেনো তাঁর দরবারে জ্ঞানী ব্যক্তিদের সুলতান মাহমুদের দরবারে পাঠিয়ে দেন। আসলে অন্যান্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে ইবনে সিনাকে পাওয়াই ছিলো তাঁর আসল উদ্দেশ্য।

ইবনে সিনা ছিলেন স্বাধীনচেতা ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সচেতন ব্যক্তি।ধন সম্পদের প্রতি তাঁর কোনো লোভ লালসা ছিলো না; কেবলমাত্র জ্ঞান চর্চার প্রতিই ছিলো তাঁর আসক্তি। তিনি নিজের স্বাধীনতা ও ইজ্জতকে অন্যের নিকট বিকিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। অন্যায় ভাবে কারও কাছে মাথা নত করতে তিনি জানতেন না এছাড়া বিনা যুক্তিতে কারও মতামতকে মেনে নিতেও রাজি ছিলেন না তিনি। এমনকি ধর্মের ব্যাপারেও তিনি যুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তাই তৎকালীন সময়ে অনেকে তাঁকে কাফির বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। আসলে ইবনে সিনা ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান। যারা তাঁকে কাফির বলেছিলেন, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি একটি কবিতা রচনা করেন। এতে তিনি লিখেছেন,”যারা আমাকে কাফির বলে আখ্যায়িত করে তাঁরা পৃথিবীতে বিখ্যাত হোক আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আমার মতো যোগ্য ব্যক্তি তোমরা আর পাবে না। আমি একথাও বলতে চাই যে, আমি যদি কাফির হয়ে থাকি তাহলে পৃথিবীতে মুসলমান বলতে কেউ নেই। পৃথিবীতে যদি একজন মুসলমানও থাকে তাহলে আমিই হলাম সেই ব্যক্তি।”গজনীর সুলতান মাহমুদ ছিলেন প্রবল প্রতাপশালী নেতা। তাঁর প্রতাপে অন্যান্য রাজা বাদশাহগণ পর্যন্ত ভয়ে কম্পমান থাকতেন। তাই গজনীতে গেলে ইবনে সিনার স্বাধীনতা ও ইজ্জত অক্ষুণ্ন থাকবে কিনা সে সম্পর্কে সন্ধিহান হয়েই তিনি গজনীতে সুলতান মাহমুদের দরবারে যেতে রাজি হননি। কিন্তু খাওয়ারিজমে তিনি এখন নিরাপদ নন ভেবে ১০১৫ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মামুন বিন মাহমুদের সহায়তায় সেখান থেকে পলায়ন করে এক অনিশ্চিত পথে রওয়ানা দেন। প্রথমে আবিওয়াদি, তারপর তুস, নিশাপুর ও পরে গুরগাও গিয়ে পৌঁছেন। এখানে এসে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে কিতাব রচনায় নিজেকে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এখানে তাঁর সুখ শান্তি স্থায়ী হয়নি। তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামে এবং শহর থেকে শহরে। কিন্তু তিনি গজনীতে যেতে রাজি হলেন না। অবশেষে তিনি যান রাও নামে একটি প্রদেশে। বিভিন্ন কিতাব লিখতে শুরু করেন৷ কিন্তু এখানেও তাঁর সুখ স্থায়ী হলো না। তাঁর জ্ঞান সাধনা ও কিতাব রচনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। তারপর তিনি চলে যান প্রথমে কাজভীন ও পরে হামাদান শহরে। এখানে এসেই তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আশ্ শেফা’ ও ‘আল্ কানুন’ লেখায় হাত দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সময় হামাদানের বাদশাহ শামস-উদ-দৌলা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে ৪০ দিন চিকিৎসা করে তাঁকে মুমূর্ষু অবস্থা থেকে সুস্থ করে তোলেন।

ক্রমান্বয়ে ইবনে সিনা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং বাদশাহ শামস-উদ-দৌলার মন্ত্রীত্বের আসন অলংকৃত করেন। এখানেও তিনি তাঁর জ্ঞান বুদ্ধি ও কর্ম দক্ষতার কারণে রাজদরবারের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিবর্গের ঈর্ষার সম্মুখীন হন। এক পর্যায়ে সমালোচকগণ সেনাবাহিনীকে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলে এবং ইবনে সিনার মৃত্যুদণ্ডের দাবি করে। বাদশাহ বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র। কিন্তু সেনাবাহিনীর দাবিকে অগ্রাহ্য করা কিংবা ইবনে সিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া কোনোটিই শামস-উদ-দৌলার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ইবনে সিনা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে আত্মগোপন করেন এবং দীর্ঘ ৪০/ ৪৫ দিন অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করেন। পরবর্তীতে বাদশাহ পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং সৈনিকগণ তাদের ভুল বুঝতে পেরে ইবনে সিনাকে খুঁজে বের করেন এবং মন্ত্রীত্বের পদ গ্রহণ করার অনুরোধ জানান। শামস-উদ-দৌলার মৃত্যুর পর সময় ও ঘটনার প্রবাহে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে চলে যান ইস্পাহানে। এ সময়ে ইস্পাহানের শাসনকর্তা ছিলেন, আলা- উদ-দৌলা। তিনি ইবনে সিনাকে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং তাঁর জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা করে দেন। এখানে তিনি উদ্যত গতিতে জ্ঞান চর্চা শুরু করেন এবং বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আশ্ শেফা’ ও ‘আল্ কানুন’ এর অসমাপ্ত লেখা শেষ করেন।

এ মনীষী পদার্থ বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, জ্যামিতি, গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় শতাধিক কিতাব রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে আশ্ শেফা, আল্ কানুন, আরযুযা ফিত তিব্ব, লিসানুল আরব, আল্ মজনু, আল্ মুবাদাউন মায়াদা, আল্ মুখতাসারুল আওসাত, আল্ আরসাদুল কলিয়া উল্লেখযোগ্য। আল্ কানুন কিতাবটি তৎকালীন যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বিপ্লব এনে দিয়েছিলো।

কারন এত বিশাল গ্রন্থ সে যুগে অন্য কেউ রচনা করতে পারেনি। আল্ কানুন কিতাবটি ল্যাটিন, ইংরেজি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয় এবং তৎকালীন ইউরোপের চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আল্ কানুন ৫টি বিশাল খণ্ডে বিভক্ত যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ লক্ষাধিক।কিতাবটি জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ ও পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। প্রকৃত পক্ষে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের তিনিই হলেন জনক। ‘আশ্ শেফা’ দর্শন শাস্ত্রের আর একটি অমূল্য, যা ২০টি খণ্ডে বিভক্ত ছিলো। এতে ইবনে সিনা রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রাণীতত্ত্ব ও উদ্ভিদ তত্ত্বসহ যাবতীয় বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি মানুষের কল্যাণ ও জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে আজীবন পরিশ্রম করেছেন এবং ভ্রমণ করেছেন জ্ঞানের সন্ধানে। তিনিই সর্বপ্রথম ‘মেনিনজাইটিস ‘ রোগটি সনাক্ত করেন। পানি ও ভূমির মাধ্যমে যে সকল রোগ ছড়ায় তা তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। সময় ও গতির সংগে বিদ্যমান সম্পর্কের কথা তিনিই আবিষ্কার করেন। তিনি এ্যারিস্টটলের দর্শন ও ভালোভাবে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু এ্যারিস্টটলের কিছু কিছু মতবাদের সাথে তিনি একমত হলেও সকল মতবাদের সাথে তিনি একমত হতে পারেননি।

জীবন সায়াহ্নে তিনি ফিরে আসেন হামাদানে। অতিরিক্ত পরিশ্রমের দরুন তিনি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। একদিন তাঁর এক ভৃত্য ঔষধের সাথে আফিম মিশিয়ে দেয়৷ আফিমের বিষক্রিয়ায় তাঁর জীবনী শক্তি শেষ হয়ে আসে। ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে মহাজ্ঞানী ও বিশ্ব বিখ্যাত এ মনীষী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হামাদানে তাকে সমাহিত করা হয়।

“আল্লাহর ভয় মানুষকে সকল ভয় থেকে মুক্তি দেয়।”…. ইবনে সিনা।

error: Content is protected !!